ধর্মবার্তা ডেস্কঃ কোরবানি অর্থ নৈকট্য, ত্যাগ–তিতিক্ষা। যেকোনো ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনই হলো কোরবানি। ইসলামি পরিভাষায় কোরবানি হলো জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগপর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা। ঈদ মানে আনন্দ। ইসলামে দুটি ঈদ—ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ ও ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। আজহা অর্থ হলো কোরবানির পশু; এর আরেক অর্থ হলো ছাগল বা বকরি। তাই একে বকরিদও বলা হয়।
ইতিহাসে প্রথম কোরবানি করেন বাবা আদম (আ.)–এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল। হাবিলের কোরবানি ছিল দুম্বা আর কাবিলের কোরবানি ছিল কিছু খাদ্যশস্য। সেকালে কোরবানি কবুল হলে আসমানি আগুন এসে তা পুড়িয়ে ছাই করে দিত, কবুল না হলে তা হতো না। হাবিলের কোরবানি কবুল হয়েছিল, কাবিলের তা হয়নি।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আদম (আ.)–এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদের শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্যজনেরটা কবুল হলো না। অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা–৫ মায়িদা, আয়াত: ২৭)।
যুগপরম্পরায় কোরবানি ছিল। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আদিষ্ট হয়েছিলেন প্রিয় বস্তু কোরবানি করার জন্য। আদেশ পালনের জন্য তিনি সব ধরনের আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ইসমাইল (আ.)-এর বদলে কোরবানি হলো বেহেশতি দুম্বা। সেই স্মৃতির নিদর্শনরূপে কিয়ামত পর্যন্ত সামর্থ্যবান সব মানুষের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব করা হলো। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সব সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি (আল্লাহ) তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা–২২ হজ, আয়াত: ৩৪)। ‘বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি ও হজ, আমার জীবন ও মরণ সমগ্র জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৬২)। ‘(হে নবী! (সা.) আপনি আপনার রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা-১০৮ কাউসার, আয়াত: ২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছে না আসে।’ (ইবনে মাজা)।
কোরবানি হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। লৌকিকতা বা সামাজিকতার উদ্দেশ্যে নয়। লাখ টাকার গরু দিয়ে লোকদেখানোর জন্য কোরবানি দিলে তা কবুল হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে ওদের গোশত–রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৩৭)।
একটি কোরবানি হলো একটি ছাগল, একটি ভেড়া বা একটি দুম্বা অথবা গরু, মহিষ ও উটের সাত ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ একটি গরু, মহিষ বা উট সাতজন শরিক হয়ে বা সাত নামে, অর্থাৎ সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যায়। কোরবানির জন্য ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বয়স এক বছর হতে হয়; গরু ও মহিষের বয়স দুই বছর এবং উটের বয়স পাঁচ বছর হতে হবে। কোরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম; অন্য কেউ জবাই দিলেও হবে। ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে জবাই করলেই কোরবানি শুদ্ধ হবে। তবে নির্দিষ্ট দোয়া জানা থাকলে পড়া উত্তম।
গরু, মহিষ ও উট সাত শরিকে কোরবানি করা যায়। হজরত জারিব (র.) বর্ণনা করেন, ‘হুদায়বিয়ার বছর আমরা নবীজি (সা.)–এর সঙ্গে কোরবানি করেছিলাম—একটি গরু সাতজনের পক্ষ থেকে, একটি উট সাতজনের পক্ষ থেকে।’ (জামে তিরমিজি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৮০)। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র.) জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (র.) সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে আমরা তামাত্তু হজ করতাম এবং আমরা একটি গরু সাত শরিকে ও একটি উট সাত শরিকে জবাই করতাম।’ (আবুদাউদ, কোরবানি অধ্যায়, পৃষ্ঠা: ৩৮৮)। ইমাম আজম আবু হানিফা (র.)-এর মতে, সব শরিকের নিয়ত থাকতে হবে ইবাদত।
কোরবানি হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। লৌকিকতা বা সামাজিকতার উদ্দেশ্যে নয়। লাখ টাকার গরু দিয়ে লোকদেখানোর জন্য কোরবানি দিলে তা কবুল হবে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে ওদের গোশত–রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৩৭)।
একজন অন্যজনের জন্য, জীবিত ও মৃতদের জন্য কোরবানি দিতে পারেন। প্রিয় নবীজি (সা.) একটি কোরবানি জবাইয়ের সময় বলেছিলেন, ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর, এটি আমার পক্ষ থেকে এবং আমার ওই সব উম্মতের পক্ষ থেকে, যারা কোরবানি করতে পারেনি।’ (সুনানে আবুদাঊদ, কোরবানি অধ্যায়, পৃষ্ঠা: ৩৮৮)।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com