Home
»
জাতীয়
» আজ ৭ জানুয়ারি ফেলানী হত্যা দিবস
চেতনা বার্তা ডেস্কঃ বিএসএফের
গুলিতে নিহত হয়ে কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফালানীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোর ছয়টার দিকে
বিএসএফ ফালানীকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর আধাঘণ্টা ধরে কাঁটাতারে আটকে
থেকে পানি পানি বলে চিৎকার করে। গুলি চালানোর পর অনন্তপুর ক্যাম্পের বিএসএফ
সদস্যরা পাশ দিয়ে টহল দিতে থাকে। এক সময় স্তব্ধ হয়ে যায় ফালানী। ঝুলে
থাকে ফালানীর লাশ। ফালানীর বাবা কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে বাংলাদেশে
এলেও মেয়ের আর্তচিৎকারে সাড়া দিতে পারেননি। এ ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পর বিএসএফ
ফালানীর লাশ ফেরত দেয়।
কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে থাকা ফালানীর
ঝুলন্ত লাশের ছবি বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেয়। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর
বর্বরতার একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় ফালানী। কিন্তু ফালানী যে দেশের নাগরিক
সে দেশের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে তা কমই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফালানী
হত্যার কড়া প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ; বরং হত্যাকারীদের সাথে
বাংলাদেশের নাকি এখন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ইতিহাসের সর্বোচ্চপর্যায়
অতিক্রম করছে। তাদের সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করা হয়েছে। ফালানীর দেশের নদীর
বুক চিরে তাদের যানবাহন চলাচলের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। আর প্রতিদান
হিসেবে বাংলাদেশ পাচ্ছে নিরীহ নাগরিকদের লাশ। মহাজোট ৫ বছরে বিএসএফ ৩০০ জন
বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে।
বিএসএফর ডিজি বাংলাদেশে এসে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কোনো বাংলাদেশী নাগরিকের ওপর তারা কোনো মারণাস্ত্র
ব্যবহার করবেন না। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি তারা রাখতে পারেননি। কারণ
বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করেই তো বিএসএফর গুলির কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে
হয়। আর যে দেশের সরকারের কাছে না চাওয়ার আগে সব পাওয়া যায় এমন এক উদার ও
বন্ধু সরকার দু-একজন মানুষ মারা গেলে আর কী বলবে? বিএসএফ যাদের মারছে তারা
তো গরিব মানুষ। এরা তো শহুরে সুশীলসমাজের কোনো সদস্য নয়। নয় বুদ্ধিজীবীর
তালিকাভুক্ত কেউ। শহুরে শিক্ষিত কেউ নয় এরা। এদের মারলে দেশের আর তেমন কী
ক্ষতি? এ কারণে ফালানী হত্যার পর সুশীলসমাজের মধ্যেও তেমন কোনো
প্রতিক্রিয়া হয়নি। ভারত এ দেশের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এবং নানা ইস্যুতে হইচই
তোলা বুদ্ধিজীবী আর সুশীলসমাজের মনস্তত্ত্ব ভালোই জানে। এদের সাথেই তো
তাদের দহরম মহরম। না জানার কোনো কারণ নেই। এ কারণে ফালানীর মতো বছরজুড়ে
বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করা হলেও এরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। যার থেকে
নুন খাওয়ার প্রশ্ন তার গুন না গাইলেও অন্তত চুপ তো থাকতে হবে?
ফালানী হত্যার পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংগঠন বিএসএফকে
একটি ‘খুনে বাহিনী’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। কারণ বিশ্বজুড়ে এটা আজ
প্রতিষ্ঠিত বিএসএফ একটি বর্বর বাহিনী। এই বাহিনী এর আগেও নারী ও শিশুদের
নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ফালানী হত্যার আগে ২০১০ সালের মে মাসে
ঠাকুরগাঁওয়ের রত্নাই সীমান্তের এক কিলোমিটার ভেতরে এসে পারুল নামে ১৪
বছরের এক কিশোরীকে হত্যা করেছিল। এ সময় খালেদা খাতুন নামে আরো একজন
গুলিবিদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তো দূরে থাক বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমেও
এসব খবর আসেনি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ছাড়া এ দেশের অন্য
মানবাধিকারজীবীরা সীমান্তে বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে
নিশ্চুপ। বিএসএফ বর্বরতার কথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনোই আন্তর্জাতিক
পর্যায়ে বা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেনি, বরং আমরা
দেখছি বিডিআর বিদ্রোহের পর সীমান্তের নাগরিকদের জীবন আরো অনিরাপদ হয়ে
উঠেছে। আর বর্ডার গার্ড এখন এই বিএসএফর মতো ‘খুনে বাহিনীর’ সাথে যৌথ টহল
দিচ্ছে বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বিএসএফ ডিজি যখন
সীমান্তে গুলি না চালানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের চেনামুখ গণমাধ্যমে
সে খবর ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছিল। কী আনন্দ! বিএসএফর ডিজি কত উদার!
বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি তাদের কত ভালোবাসা! ডিজির কথার তো মূল্য থাকা
চাই। সে কারণে কয়েক মাস গুলি চালানো বন্ধ ছিল। কিন’ হত্যা বন্ধ হয়নি।
শুধু কৌশল বদল হয়। গুলির বদলে পাথর ছুড়ে হত্যা করে নদীতে লাশ ভাসিয়ে
দেয়া হয় বাংলাদেশী নাগরিকদের। ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে সীমান্ত নদীতে ২৪
আগস্ট মাছ ধরতে গিয়েছিল বাবুল হোসেন। মাছ ধরা হয়নি, পাথর ছুড়ে তাকে
হত্যা করা হয়।
কিন্তু এভাবে তো সব সময় বেশি মানুষ মারা যায় না।
সবাইকে তো পাথরের আওতার মধ্যেও পাওয়া যায় না। শুরু হলো আবারো গুলি। ২০১১
সালের বিজয় দিবসের দিন একজনকে হত্যা করে বাংলাদেশের মানুষের উদ্দেশে
রক্তিম শুভেচ্ছ পাঠায় বিএসএফ। এর পরদিন হত্যা করা হয় তিনজনকে। এই
শুভেচ্ছার জবাবও বাংলাদেশ উদারভাবেই দিয়েছে। বিজয় দিবসের রাষ্ট্রীয়
অনুষ্ঠানে রিটায়ার্ড লে. জেনারেল এইচ এস পানাগের নেতৃত্বে ভারতীয় সশস্ত্র
বাহিনীর ২১ জন সদস্য যোগ দেন। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে
এসেছেন, তাদের মধ্যে ১৯ জন এসেছেন সস্ত্রীক। এর মধ্যে বিএসএফের হয়তো সাবেক
কোনো কর্মকর্তাও ছিলেন।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী
ধারাবাহিকভাবে প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তে খুন করে যাচ্ছে বাংলাদেশী
নাগরিকদের। আর সে কারণেই ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশীদের জন্য এক
বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ সীমান্ত চলে গেছে কারো উঠানের ওপর দিয়ে, কারো
জমিনের পাশ দিয়ে, খালের ধার দিয়ে। নদী পেরিয়ে। এপারের-ওপারের মানুষের মধ্যে
যোগাযোগ আছে। সুখ-দুঃখের আদান-প্রদান আছে। উৎসবে খাদ্য সামগ্রির বিনিময়
আছে। বৈবাহিক সম্পর্ক আছে। দেশ দু’টি হলেও ভাষার সাযুজ্য আছে। কখনও কখনও
সীমান্তের দু’পাশে, কাঁটাতারের বেড়ার এপাশে-ওপাশে দাঁড়িয়ে দু’ দেশের মানুষ
সুখ-দুখের গল্প করে। কলাটার-মুলাটার বিনিময় করে। মানুষের মধ্যে সম্পর্ক এ
রকমই। তাদের মধ্যে কোন শত্রুতা নেই। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী ঘাতকবাহিনী
বিএসএফ এর কাছে এসবের কোন মূল্য নেই। তারা বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে
বাংলাদেশী মানুষ দেখলেই যেন রক্ত পিপাসায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। যথেচ্ছ গুলী
চালিয়ে হত্যা করে। এভাবে ২০১০ সালে তারা হত্যা করেছে কমপক্ষে ৭৪ জন
বাংলাদেশী নিরীহ মানুষকে। বিএসএফ এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করে কখনও কখনও গুলী
করে, কখনও কখনও বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ঢুকে ধরে নিয়ে যায়
বাংলাদেশীদের। তারপর অকারণেই নির্দয়ভাবে তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। গত চার
বছরে, সেনাসমর্থিত মইন উদ্দিন- ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে ও বর্তমান মহাজোট
সরকারের আমলে এই হত্যাযজ্ঞ পৈশাচিক উল্লাসে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান
সরকারের আমলে বর্বর ভারতীয় বাহিনীর এই পৈশাচিকতা ফ্রি-স্টাইল লাইসেন্সের
রূপ নিয়েছে। আর নরঘাতক ভারতীয় বাহিনীর এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে
একবারও প্রতিবাদ করতে পারেনি বাংলাদেশের সরকার। পৃথিবীর সকল দেশই কারও না
কারও সীমান্তে ঘেঁষে অবস্থিত। কিন্তু পৃথিবীর আর কোন দেশেই এরকম
হত্যাযজ্ঞের নজির নেই। বাংলাদেশ সরকার বলেই যাচ্ছে যে, ভারত বন্ধুপ্রতিম
দেশ কিংবা তাদের ত্রাতা। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান বলতে গেলে প্রকাশ্য
শত্রুভাবাপন্ন দেশ। পাকিস্তান সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর এমন হত্যাযজ্ঞের কথা
কখনওই শোনা যায় না। কারণ ভারত জানে সীমান্তে এরকম একটি গুলী ছুঁড়লে তার
সমুচিত জবাব তারা পাবে। সে কারণেই সেখানে হাত সৈই করার কোন চেষ্টাই ভারতের
এই বর্বর বাহিনী করে না। অথচ এতো যে হত্যাযজ্ঞ বুলেটে তার জবাব না দিলেও
কাগজেও তার প্রতিবাদ করতে পারছে না সরকার। কোথায় যে ভয়। যেন, প্রভু না হয়
দু’চারজন দরিদ্র মানুষকে খুন করলই। অযথা তার প্রতিবাদ করে গদি নড়বড়ে করার
কোন মানে হয় না। সে কারণে একেবারে চুপ আছে বাংলাদেশের সরকার।
এর
মধ্যে সবচাইতে লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটেছে ৭ই জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী
সীমান্তে। সেখানে ১৫ বছরের এক শিশু ফেলানী কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে
বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় জড়িয়ে পা
ফসকে ঝুলে পড়েছিল সে। তখন সাহায্যের জন্য ফেলানী চিৎকার করে আবেদন করছিল।
কিন্তু বিএসএফ-এর রক্ত পিপাসু ঘাতকরা সে আবেদনের সাড়া না দিয়ে তাকে গুলী
করে হত্যা করে তেমনি ঝুলন্ত অবস্থায়ই। ঐ নরঘাতকরা তাকে হত্যা করে তার লাশ
নামিয়ে নিয়ে যায়নি। বরং পরবর্তী পাঁচ ঘণ্টা ফেলানীর লাশ ঝুলেছিল কাঁটাতারের
বেড়ার ওপরই। যেন বিএসএফ বাংলাদেশী মানুষদের জানান দিতে চেয়েছিল যে,
সীমান্তের কাছাকাছি এলে এভাবেই বাংলাদেশীদের হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে
রাখা হবে।
ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় ছাপা
হয়েছিল। পরে ছাপা হয় বাংলাদেশের দু’ একটি পত্রিকাতেও। সে মর্মান্তিক দৃশ্য
চোখে দেখা যায় না। কিন্তু তাতেও বাংলাদেশের সরকার জোরালো প্রতিবাদ জানাতে
ব্যর্থ হয়েছে। ফেলানীর এই ঘটনার পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বরাষ্ট্র
সচিব পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে বৈঠকের ফলাফলও শূন্য। গত চল্লিশ বছর
ধরে ভারত সহস্রবার কথা দিয়েছে যে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা তারা বন্ধ করতে
ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু ঐ প্রতিশ্রুতি পর্যন্তই। তারা যখন ঢাকায় বসে এ রকম
প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করেছে ঠিক তখনই হয়তো কোন সীমান্তে তাদের রক্ত পিপাসু
বাহিনী অকারণেই কোন বাংলাদেশীকে গুলী করে হত্যা করেছে। ফেলানীর ঘটনায় শুধু
বাংলাদেশী মানুষেরাই নয় সারা পৃথিবীই যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। শুধু
স্তম্ভিত হয়নি বাংলাদেশের সরকার। তবু ধারণা করা হয়েছিল যে, ফেলানীর এই
ঘটনার পরে নিতান্তই চক্ষু লজ্জার কারণে হলেও ভারতীয় রক্ত পিপাসু এই বাহিনী
সাময়িকভাবে হলেও সীমান্তে নরহত্যা বন্ধ করবে। কিন্তু তা হয়নি। ঘটনার
কয়েকদিন পরেই আবারও ঘটেছে আরেক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। কাঁটাতারের বেড়ার
এপাশে-ওপাশে দাঁড়িয়ে ভারত ও বাংলাদেশের দু’ বন্ধু হাসিঠাট্টার গল্প
করছিলেন। ভারতীর ঘাতক বাহিনী সেখানেই বাংলাদেশী বন্ধুটিকে গুলী করে হত্যা
করে। পৃথিবীতে এমন বর্বর জাতির অস্তিত্ব আর আছে কিনা সন্দেহ।
বাংলাদেশের নতজানু সরকার চোখ বন্ধ করে থাকলেও চোখ বন্ধ করেনি সারা পৃথিবীর
মানুষ। বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছে যে, ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত যেন এক
বধ্যভূমি। বিএসএফের মিশনই গুলী করে বাংলাদেশীদের হত্যা করা। ভারতীয় বাহিনী
বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলী করছে স্রেফ হত্যার জন্যই। এমনকি ভারতীয়
নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন যে, ভারতে
অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকারী নিরস্ত্র বেসামরিক লোকদের তারা হত্যা করেছে।
দেখামাত্র গুলী বর্ষণের কারণে সীমান্ত এলাকাটি এখন বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে।
গার্ডিয়ান লিখেছে, সুন্দর বেড়া কী সুপ্রতিবেশী বানায়? বাংলাদেশের সীমান্তে
ভারত ২ হাজার কিলোমিটার বেড়া নির্মাণ করেছে। একসময় যে জনগণ বৃহত্তর বাংলার
অংশ ছিল আজ ভারত অবৈধ অভিবাসন, চোরাচালানি ও সরকারবিরোধী জঙ্গী
অনুপ্রবেশের কথা বলে তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী
যেভাবে নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের হত্যার জন্য গুলী করার নীতি বাস্তবায়ন করছে,
এমন নজির বিশ্বের কোথায়ও নেই। গত ১০ বছরে বিএসএফ প্রায় এক হাজার
বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। ফলে সীমান্ত এলাকা এশিয়ান বধ্যভূমিতে পরিণত
হয়েছে। অসংখ্য নিরস্ত্র ও নিরুপায় স্থানীয় মানুষের ওপর ঠান্ডা মাথায়
হত্যাকান্ড চালানোর স্পষ্ট প্রমাণ করা সত্ত্বেও কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা
হয়নি।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো ভারতীয় অনেক কর্মকর্তাও সীমান্তে
নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যার অনুমোদন করেন। আরও দুঃখজনক হলো মানবাধিকার
সংরক্ষণ নিয়ে সোচ্চার ও দাবিদার বিদেশী সরকারগুলোকেও এসব হত্যাকান্ডের
ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে না। মেক্সিকো সীমান্তে মার্কিন আইন
প্রয়োগকারী সংস্থার একটি মাত্র হত্যাকান্ডও বিরাট শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
অথচ বাংলাদেশী গ্রামবাসীদের ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি
পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের অধিকার ভারতের রয়েছে।
কিন্তু জীবন রক্ষার অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ করার কোন
অধিকার ভারতের নেই। যদিও অনেক ভারতীয় কর্মকর্তা প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন
যে, নিরস্ত্র বেসামরিক লোকদের হত্যা করা হচ্ছে। বিএসএফ প্রধান রমন
শ্রীবাস্তব নিহতদের জন্য দুঃখবোধ উচিত নয় দাবি করে বলেছেন, এসব লোক যেহেতু
অবৈধভাবে ভারতীয় ভূ-খন্ডে প্রবেশ করছে তাই তারা নির্দোষ নয় এবং তারা
ন্যায়সঙ্গত লক্ষ্যবস্তু। এক্ষেত্রে দুঃখজনক ব্যাপার হলো বাংলাদেশী সীমান্ত
কর্মকর্তারা বলছেন, চোরাচালানের ঘটনা ঘটলে এসব হত্যাকান্ড গ্রহণযোগ্য।
আওয়ামী লীগ সরকারের ৫ বছরে সীমান্তে বিএসএফ হত্যা করেছে ৩০০ জন
বাংলাদেশিকে। ছয়টি দেশের সঙ্গে সীমান্ত থাকলেও শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই
হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ভারত। ২০০০ সালের পর গত একযুগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী
বাহিনী বিএসএফ ১০৩৯ নিরীহ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। এ সময় ভারতের সঙ্গে
অন্য পাঁচটি সীমান্তে একটি হত্যার ঘটনাও ঘটেনি।
বাংলাদেশ ছাড়া
ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে।
ভারতের সবচেয়ে বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তান সীমান্তেও গত ১০ বছরে কোনো
বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
বাংলাদেশের জাতীয় দিবস ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোতে হত্যার ঘটনা কি কাকতালীয় নাকি পরিকল্পিত বর্বরতা?
২০১১ বাংলা নববর্ষে ২ বাংলাদেশিকে হত্যা
১৪ এপ্রিল ২০১১ ভোরে বাংলা নববর্ষে যশোর জেলার বেনাপোলের সাদীপুর সীমান্তে
বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় মুন্না (১৮) নামে এক বাংলাদেশি যুবক ও আহত হয়
মামুন (২৩)।
একই দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর সীমান্তবর্তী নীতপুর
সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফের গুলি করে হত্যা করে
সানাউল্লাহ (৩২) নামের এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীকে।
২০১২ বাংলা নববর্ষে ১ বাংলাদেশিকে হত্যা
১৪ এপ্রিল ২০১২ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তে ভারতীয়
সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ফারুক হোসেন (২৫) নামে এক বাংলাদেশি
যুবক নিহত হয়।
মে দিবসে ১ বাংলাদেশিকে হত্যা
৩০ মে রাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে রহমত আলী (৩৫) নামের বাংলাদেশী এক রাখাল নিহত হয়েছে।
বিজয় দিবসে ৪ বাংলাদেশিকে হত্যা
১৬ ডিসেম্বর ২০১১ বিজয়ের ৪০ বছর উদযাপনের সময় বিএসএফের গুলিতে মেহেরপুরের
গাংনী উপজেলার সাহেববাড়িয়া সীমান্তে নিহত হন নাহারুল (৪০) নামে এক
বাংলাদেশী।
একই দিন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা সীমান্তে বিএসএফ’র
বোমার আঘাতে আনোয়ার হোসেন (২৭) নামে এক বাংলাদেশী নিহত হন। এ সময় আহত হন
মোহর আলী (২৫) নামে আরো একজন।
একই দিন দিনাজপুর জেলার বিরামপুর
সীমান্তে গভীর রাতে মতিয়ার (২০) ও তাইজুদ্দিন (৩০) নামে দুই বাংলাদেশীকে
বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে।
পবিত্র ঈদের দিনও বাংলাদেশি যুবককে পিটিয়ে হত্যা
২০ আগস্ট ২০১২ পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার
জগতবেড় ইউনিয়নের ভোট হাটখাতা সীমান্তে দুপুরে ভারতীয় চেনাকাটা ক্যাম্পের
সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) জাহাঙ্গীর আলম বাবলু (২৫) নামে এক
বাংলাদেশীকে পিটিয়ে হত্যা করে।
ইংরেজি নববর্ষে ৪ বাংলাদেশিকে হত্যা
১ জানুয়ারী ২০১৩ ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে মুক্তার
আলম (২৮) ও তরিকুল ইসলাম ওরফে নূর ইসলাম (২৮) নামে ২ বাংলাদেশি যুবককে।
তাদের গুলিতে আহত হয়েছেন আরো তিনজন। । এ ঘটনায় আহতরা হলেন আমজাদ (২৫),
সামাদ (২৯) ও রাজু (২৩)। এদের মধ্যে রাজু মোলানী সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হন।
বুধবার ভোর রাত ৩টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা সীমান্তে
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে মাসুদ (২৩) এবং শহীদুল
ইসলাম(২৮) দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
সীমান্তে বছরের পর বছর ধরে
বিএসএফের মানতাবিরোধী গণহত্যার শেষ কোথায়? বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের
দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি সৈয়দ আশরাফের কাছে ফেলানীদের মৃত্যু কিংবা হাবিবদের
উপর বর্বরতা কোনো বিষয় নয়। আজকে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম.খা. আলমগীর
বললেন, “আত্মরক্ষার জন্য বিএসএফ গুলি চালাতে পারে।
‘আক্রমণের জবাবে গুলি চালিয়েছে’
বিএসএফ আত্মরক্ষায় গুলি চালালে কথা নেই : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ঠান্ডা মাথায় বিএসএফের এ ধরনের হত্যাকান্ড কখনও বিচারের মুখোমুখি হয় না।
এমনকি পুলিশও এসব হত্যাকান্ডের জন্য নিজেরা কোন মামলা দায়ের করতে পারে না।
আর মামলা দায়ের করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে। ফলে পুলিশ এতো
ঝামেলায় যেতে চায় না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয়
ভূমিতে প্রবেশ করলেও তারা গুলী করে হত্যা করার অধিকার রাখে। কিন্তু
বিএসএফের হত্যাকান্ড ৯৯ ভাগই সংঘটিত হয় বাংলাদেশ ভূ-খন্ডের ভেতরে। এতেও চুপ
করে থাকে বাংলাদেশের মেরুদন্ডহীন নতজানু সরকার। ফলে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত
এখন এশিয়ার বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের নতজানু সরকার ও ভারত
উভয়কেই উপলব্ধি করতে হবে যে, জনগণ সবসময় নীরবে এই হত্যাকান্ড মেনে নেবে না।
কোনো কোনো সীমান্তে তারা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশী মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ ও
তার শক্তি প্রত্যক্ষ করেছে। সেই প্রতিরোধ বাংলাদেশের সরকার ও ভারতীয়
কর্তৃপক্ষকে উপলব্ধি করতে হবে।
স্বাধীনতার পর ভারত বাংলাদেশ থেকে
ভয়াবহ রকম অর্থনৈতিক সুবিধা নেওয়ার পর একে একে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন,
পার্বত্য চট্রগ্রামে অস্থিরতা সৃষ্টি, সীমান্তে বাংলাদেশিদের পাখির মত গুলি
করা, বন্দর, ট্রানজিট, ………প্রভূতি সহ প্রায় সব কিছুই উপর তাদের নিয়ন্ত্রন ও
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
এসব সুবিধা যাদের মাধ্যমে তারা পাচ্ছে
বিনিময়ে তারা স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি উপাধিসহ আরো কিছু পাচ্ছেন। আর
যারা দেশের স্বার্থে এসবের প্রতিবাদ করছেন তারা জেল, জুলুম, বাড়ি হারানো
ছাড়াও রাজাকার, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি প্রভূতি উপাধি পাচ্ছেন।
একটি বার্তা সংস্থা খবর দিয়েছে, ফালানীর কবরে ফুল ফুটেছে। ফালানী মারা
যাওয়ার পর ছোট ভাই, মা আর বাবা কবরে ফুলগাছ লাগিয়েছিলেন। থোকা থোকা হলুদ
রঙের গাদাফুলগুলো হাসছে। এই হাসি যেন কিশোরী ফালানীর হাসি। অবজ্ঞার হাসি।
ফালানী দেশের শিক্ষিত শহুরে মানুষকে বলছে, কোথায় তোমাদের স্বাধীনতা।
ফালানীর আত্মা আজ বলছে, স্বাধীনতা রক্ষার নামে কত চেতনার কথাই না তোমরা
বলো। কোথায় আজ স্বাধীনতা রক্ষার চেতনা। যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিদেশী
বাহিনীর গুলি থেকে রক্ষা করতে পারে না সে রাষ্ট্র কী স্বাধীন? যে রাষ্ট্রের
সরকার পাথর ছুড়ে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার প্রতিবাদ করতে পারে না সে
দেশ কী স্বাধীন? ফালানী নয়, কাঁটাতারে যে এক খণ্ড বাংলাদেশ ঝুলে ছিল সে
বোধ কি আমাদের আছে? বাংলাদেশ পরাধীনতাই যদি নিয়তি হয় তাহলে কাঁটাতারের
ওপারে বন্দুকধারীদের নিশানাই বা কেন? আজকে বাংলাদেশের ফালানীর সমবয়সী
কিশোর-তরুণদের সামনে এখন এই প্রশ্নগুলোই তো বড় হয়ে আসার কথা? ফালানীর নাম
উচ্চারিত হবে আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। সেই
প্রতিবাদে শামিল হওয়ার এখনই সময়।
দুঃখ পাই যখন দেখি এদেশের
তরুণসমাজ টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। যখন তিতাস নদীর ওপর ২৭
টি বাঁধ দেয়া হয়, ফেলানীকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হয়, হাবিবকে
উলঙ্গ করে নির্যাতন করা হয় তখন তরুণ সমাজ জেগে ওঠে না।
দেশের
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তথা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তরুণ প্রজন্মকে
জেগে ওঠা ছাড়া আর কোন পথ নেই। কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে তো বিভিন্ন উপায়ে
ঘুমের ঘোরে রাখা হয়েছে। তাদেরকে ঘুম থেকে জাগাবে কে?
দেশের
বর্তমান পরিস্থিতিতে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা দেখে জনৈক ব্যক্তি সেদিন আক্ষেপ
করে বলছিলেন- দেশটা বিক্রি হয়ে গেলেও সম্ভবত আমাদের তরুণদের ঘুম ভাঙ্গবে
না এবং তিনিই বলছিলেন, ঘুম ভাঙ্গবে কি করে, তাদেরকে তো ঘুম পাড়িয়ে রাখা
হয়েছে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি কিংবা অন্য কোনো দলের বাংলাদেশ দেখতে চাই না, আমরা চাই সবার বাংলাদেশ।
মালয়েশিয়া যখন বলে ‘এক মালয়েশিয়া’, তখন স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও আমরা
জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দু’ভাগে বিভক্ত করা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি! আজকে
বিচারপতি, আইনজীবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবি, শ্রমিক, কৃষক সব জায়গাতেই
২ দলে বিভক্ত। বিদেশী শকুনদের হাত থেকে দেশের সম্পদকে রক্ষা করে সামনে
এগুতে একটি শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য সময়ের দাবী। তবে তার দর্শন হতে হবে ন্যায় ও
দেশপ্রেম।
তরুণ প্রজন্মের সত্যিকার প্রয়োজন ও চাওয়া-পাওয়ার দিকে
কোন নজর দিন। একবিংশ শতাব্দীর অগ্রসরমান বিশ্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে
মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে অযৌক্তিক আবেগ পরিহার করে বাস্তবমুখী হওয়া
দরকার।
বিএসএফের বর্বতার শিকার হয়ে সীমান্তে লাশ হওয়া হাজার হাজার পরিবারকে সান্ত্বনা কোনো ভাষা নেই- আমরা বাকরুদ্ধ!
বি. দ্র. বন্ধুরা প্লিজ, ৭ জানুয়ারি ফেলানী দিবসে সীমান্তে অনবরত নিরীহ
মানুষ হত্যা তথা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাতের বিরুদ্ধে
অনলাইন দুনিয়াসহ সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় তুলুন।
তথ্যসূত্র:
- জাতীয় দৈনিকসমূহ
লেখক : ব্লগার হাসান