মাছুম বিল্লাহঃ একটি জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের তথা পুরো জেলার প্রাথমিক শিক্ষার অভিভাবক বলা যায় ডিস্ট্রিক্ট প্রাইমারি এডুকেশন অফিসার বা ডিপিইওকে; একইভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার অভিভাবক বলা যায় ডিস্ট্রিক্ট এডুকেশন অফিসার বা ডিইওকে। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার ২৪টিতে কোনো জেলা শিক্ষা অফিসার নেই; অর্থাৎ অভিভাবকহীন অবস্থায় চলছে প্রায় অর্ধেক জেলার মাধ্যমিক শিক্ষা। এর মধ্যে অনেক জায়গায় সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসারও নেই। শিক্ষার অনেক চিত্রের মধ্যে এটি আরেকটি বড় নমুনা- শিক্ষাকে আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আসলেই কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। এতগুলো জেলায় জেলা শিক্ষা অফিসার না থাকার কারণ কী? আমরা সচরাচর শুনি না, একটি জেলায় জেলা প্রশাসক নেই কিংবা পুলিশ সুপার নেই। কিন্তু জেলা শিক্ষা অফিসার ছাড়া কীভাবে চলছে এসব জেলার শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যাবলি?
প্রচলিত পদ্ধতিতে দুভাবে জেলা শিক্ষা অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে ৮০ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ সরাসরি পরীক্ষার মধ্যেমে। এ দুটো পদ্ধতিতেই সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষকদের মধ্যে থেকে ডিইও হলে সেটি ভালো এ অর্থে যে, এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ডিইওদের শিক্ষকতার সরাসরি অভিজ্ঞতা রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষার খুঁটিনাটি তারা জানেন, শিক্ষায় বিরাজমান সমস্যাবলি সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল এবং শিক্ষার্থীদের সমস্যাও জানেন। আর সরাসরি যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তারা এসব বিষয়ে পিছিয়ে থাকেন; যদিও তাদের সাধারণজ্ঞান একটু বেশি থাকে। বয়স কম বলে একটু স্মার্ট থাকেন এবং হয়তো দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এসেছেন। কিন্তু শিক্ষাসংক্রান্ত সমস্যাবলি, যেগুলো সরাসরি শিক্ষকতা না করলে তার ভেতরে প্রবেশ করা যায় না- সেসব বিষয়ে তারা পিছিয়ে থাকেন।
বর্তমানে ২৪ জেলায় কোনো জেলা শিক্ষা অফিসার নেই, এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোতে সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসারও নেই। ওইসব জেলার কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ওইসব প্রধান শিক্ষক কি তাদের স্কুল চালাবেন, নাকি জেলার শিক্ষা প্রশাসন তদারকি করবেন? এতে তো কোনো দিকই ঠিকমতো সুসম্পন্ন হওয়ার কথা নয়। শিক্ষা অফিসার, সহকারী শিক্ষা অফিসার ছাড়া কীভাবে একটি জেলা চলতে পারে, বোধগম্য নয়। একটি জেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের সব ধরনের কার্যক্রম যেমন- মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর কার্যাবলি মনিটরিং করা, বিনামূল্যের বই বিতরণ, এমপিওভুক্তির আবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সেগুলো বিভাগীয় শিক্ষা অফিসে পাঠানো, সরকারি বিভিন্ন নির্দেশনা উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছে পৌঁছানো ও বিদ্যালয়গুলোতে পৌঁছেছে কি না, তা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ভূমিকা রাখা, যাতে বিদ্যালয় কমিটিগুলো এনটিআরসি প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে না পারে ইত্যাদি।
মাউশির নয়টি রিজিওনাল অফিসের তিনটিতে পরিচালকও কিংবা উপপরিচালকও নেই। সেখানে একজন প্রধান শিক্ষক দায়িত্ব পালন করছেন। মাউশি থেকে বলা হয়েছে- বর্তমানে জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদায়নের উপযুক্ত কোনো শিক্ষক নেই। যাদের ২০১৮ সালে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ কেমন কথা? একজন জেলা শিক্ষা অফিসার ছাড়া যদি একটি জেলার শিক্ষা চলতে পারে, তাহলে এ চিত্র থেকেই বোঝা যায়, ওইসব জেলায় কী ধরনের শিক্ষা চলছে। বড় বড় জেলায় আবার জেলা প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য একজন করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক-শিক্ষা রয়েছেন। এটি একদিকে ভালো মনে হয়, কারণ জেলায় প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষার কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকে। প্রশাসন থেকে কিংবা কেন্দ্র থেকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবং খবরাখবর জানার জন্য হয়তো এ পদটি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক-শিক্ষার সঙ্গে কী ধরনের সমন্বয় বা মতবিনিময় হয় জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের। তাদের কাজের মধ্যে মূল পার্থক্যগুলোই বা কোথায়? তাহলে যেসব জেলায় জেলা শিক্ষা অফিসার নেই, সেগুলোতে এডিসি-শিক্ষার ভূমিকাই বা কী এবং কেমন? এ প্রশ্নগুলোর সমাধান হওয়া উচিত। কারণ জনগণ, বিশেষ করে সংশ্লিষ্টদের জানা উচিত- এডিসি-এডুকেশন এবং জেলা শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও জেলা শিক্ষা অফিসারদের মধ্যে কাজের কী ধরনের সমন্বয় করা হয় এবং কীভাবে করা হয়।
জেলা শিক্ষা অফিসার, যিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক এবং ডিপিইও বা ডিস্ট্রিক্ট প্রাইমারি এডুকেশন অফিসার এ দুটো পদকেই ক্যাডার সার্ভিসের আওতায় আনা উচিত। শিক্ষায় যদি আমরা গুরুত্ব প্রদান করতে চাই, তাহলে এ বিষয়ে অবহেলা করার সুযোগ নেই। বর্তমানে যেসব জেলায় শিক্ষা অফিসার নেই, সেগুলোয় শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বসানো যেতে পারে। সরকারি বিদ্যালয়ের যেসব প্রধান শিক্ষকদের জেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে পদায়ন করা হয়, তাদের মধ্যে অনেকেরই চাকরির বয়স বেশিদিন থাকে না; ফলে তাদের কাজের প্রতি খুব একটা আগ্রহ থাকে না। আর একটি বিষয় হচ্ছে বয়স। প্রধান শিক্ষকরা স্বভাবতই একটু বয়স্ক থাকেন, তাই সবাই সেভাবে শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে পারেন না। অতএব শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এখানে পদায়নের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেসব শিক্ষকের চাকরির বয়স পনেরো বছর হয়েছে, তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন দেখে, শ্রেণি উপস্থাপনা দেখে, লিখিত পরীক্ষা নিয়ে, সংক্ষিপ্ত একটি প্রশিক্ষণ দিয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার পদে বসানো যেতে পারে। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের শিক্ষকদেরই এ সুযোগ দেয়া উচিত; কারণ মাধ্যমিকের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। সেখানে অনেক ভালো মানের শিক্ষক আছেন যারা বয়সজনিত কারণে, সুবিধার কারণে, তদুপরি সরকারি প্রতিষ্ঠান কম হওয়ার কারণে সরকারি শিক্ষক হতে পারেননি। কিন্তু তার মানে এই নয়, তারা পটেনশিয়াল নন।
আরও একটি বিষয় আমি লক্ষ করেছি- মাউশির সঙ্গে জেলা শিক্ষা অফিসারদের নিয়মিত সভা অনুষ্ঠিত হয় না। ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি থেকে জেলা শিক্ষা অফিসারদের বার্ষিক সভার আয়োজন করা হতো লার্নিং (ব্র্যাকের নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র) সেন্টারগুলোয়। সেখানে মাউশি কর্মকর্তাদেরও আহ্বান জানানো হতো। বিভিন্ন প্রজেক্টের প্রজেক্ট ডাইরেক্টরদেরও আহ্বান জানানো হতো। জেলা শিক্ষা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি- তাদের মধ্যে এ ধরনের নিয়মিত কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয় না। বিষয়টি আমার কাছে অবাকই লেগেছে। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে জেলা শিক্ষা প্রশাসনের যদি নিয়মিত যোগাযোগই না হয়, মতবিনিময় না হয়, তাহলে সুষ্ঠু সমন্বয় এবং সুষ্ঠু কাজ সেখানে সম্পাদন হয় বলে আমরা ধরে নেব? এ ধরনের ‘গ্যাপ’ থাকা মানে পুরো শিক্ষা প্রশাসনে গ্যাপ থাকা।
২০১২ সাল থেকে সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয় এবং আর একটি পদ তৈরি করা হয় সিনিয়র শিক্ষক পদবিতে। এ পদ প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার। সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটি ছিল জেলা শিক্ষা অফিসারের ওপরে। বর্তমানে প্রধান শিক্ষক ও জেলা শিক্ষা অফিসার ষষ্ঠ গ্রেডের। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে জেলা শিক্ষা অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়, তা জটিল মনে হয়। এত জটিল না করে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যায়ের জন্য আলাদা একটি শিক্ষা ক্যাডার থাকা প্রয়োজন। সেটি করতে হয়তো সংসদে আইন পাস করতে হবে; কিন্তু এর আগ পর্যন্ত উন্মুক্ত পদ্ধতিতে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে থেকে কমপক্ষে পনেরো বছরের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের জেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত; যাতে জেলা শিক্ষা অফিসার ছাড়া একটি জেলার মাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালিত না হয়। তবে নিয়োগের পরপরই তাদের নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে, যাতে তারা দেশ-বিদেশের শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন; কীভাবে দক্ষ শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা করতে হয় সে ব্যাপারে জানতে পারেন এবং তা সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে পারেন।
মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও বাউবি শিক্ষক
masumbillah65@gmail.com