লালমনিরহাট: দীর্ঘ ১০ বছর ধরে পায়ে শিকল বাঁধা জীবন কাটাচ্ছেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মানসিক ভারসম্যহীন সোহাগী বেগম (১৮)।
উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের নামুড়ি কদমতলা মোড় এলাকার দুলাল মিয়ার মেয়ে সোহাগী।
দুলাল মিয়ার চার মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। জন্মের পরে ভালোই ছিলেন তিনি। আদর করে বাবা-মা নাম রাখেন সোহাগী। চার বছর বয়সে হঠাৎ বাড়ির পাশের পুকুরে ডুবে আহত হন তিনি। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পেট থেকে পানি বের করেন। আর এ জন্য সোহাগীর পা ধরে ঘোরানো হয়। এতে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায় তখনকার চার বছরের সোহাগী।
পানিতে ডুবে প্রাণ বাঁচলেও তাকে দেওয়া চিকিৎসাই যেন কাল হয়ে য়ায় সোহাগীর। ওই সময় তার মানসিক বিকাশে বাঁধাগ্রস্ত হয়। ধিরে ধিরে বাড়তে থাকে মানসিক বিকারগ্রস্ততা। অভাবের সংসারে আদরের সন্তানকে সুস্থ্য করতে প্রাণপন চেষ্টা করে তার পরিবার। কিন্তু কোনো কিছুতেই তার কোনো উন্নতি হয়নি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থতা আরও বাড়তে থাকে।
একটা সময় পরে বাইরে বের হলেই ছুটে গিয়ে অন্যের ক্ষতি করা শুরু করেন সোহাগী। এতে প্রতিবেশীরা এক পর্যয়ে বিরক্ত হয় পড়েন। পরে বাধ্য হয়েই তাকে ঘরে আটকিয়ে রাখেন পরিবারের সদস্যরা। সন্তান হারানোর ভয়ে আর অন্যের ক্ষতি না করার জন্য তারা গত ১০ বছর ধরে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখছেন সোহাগীকে।
প্রতিদিন ভোর হলে বাড়ির পাশের একটি গাছের সঙ্গে সোহাগীর পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। আর সন্ধ্যা হলে বাঁধা হয় ঘরের বিছানার সঙ্গে। এভাবেই চলে তার খাওয়া প্রসাব পায়খানা সবই।
কথাও বলতে পারেন না সোহাগী। পেটে ক্ষিদে পেলে শুধু চিৎকার করেন। খাওয়ার রুচিও বেশি। গরিব বাবা দুলাল মিয়া সামান্য পুঁজির ঝিল মাংস বিক্রেতা (ছাটাই মাংশ বিক্রেতা)। সেখানে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে ছয় সদস্যের সংসার। অভাবের কারণে তিনি চাহিদা মতো খাবারও দিতে পারেন না মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ে সোহাগীকে।
এক সময় নামুড়ি গুচ্ছগ্রামে অন্যের নামে বরাদ্ধের ঘরে থাকতেন দুলাল মিয়া। সেই জরাজীর্ন ঘরটিতেও এখন থাকার মতো পরিবেশ নেই। তাই স্ত্রী সাবিনা বেগমের পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া মাত্র দুই শতাংশ জমিতে ঘর তুলে কোনো রকম জীবন যাপন করছেন তারা।
আদরের মেয়ে সোহাগীর সুস্থ্য জীবন দেখার প্রচণ্ড স্বাধ থাকলেও সেটি তাদের সাধ্যের বাহিরে। প্রতিনিয়ত দীর্ঘশ্বাসে কাটে দুলাল-সাবিনা দম্পতির সংসার। অভাবের পরেও যখনই ভালো চিকিৎসকের সন্ধান পেয়েছেন, সেখানেই তারা ছুটেছেন মেয়ের চিকিৎসার জন্য। কিন্তু অর্থের অভাবে কোনো বারেই সম্পূর্ণ চিকিৎসা করাতে পারেননি তারা।
নিরুপায় হয়ে জন্মদাতা বাবা-মা সকালে ঘুম থেকে উঠেই গবাদি পশুর মতো নিজের মেয়েকে গাছের সঙ্গে শিকলে বেঁধে রাখেন। আবার সন্ধ্যা হলে একইভাবে বিছানার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখতে হয় আদরের সন্তানকে।
সোহাগীর মা সাবিনা বেগম বলেন, পৃথিবীর সব চেয়ে কঠিন কাজ পেটের সন্তানকে শিকলে বেঁধে রাখা। প্রতিদিনই এ কাজটি করতে হচ্ছে। সোহাগীর প্রসাব পায়না যুক্ত কাপড় পরিস্কার করতেও কষ্ট হয় না। কিন্তু যখন মেয়েকে গরু ছাগলের মতো গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখি তখন বুকটা ছিঁড়ে যায়। টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। উপযুক্ত চিকিৎসা করালে সোহাগী সুস্থ হতে পারতো। এ জন্য সমাজের বিত্তবানরা কেউ সাহায্য করলে আমার মেয়েকে সুস্থ করতে পারতাম।
সোহাগীর বাবা দুলাল মিয়া বলেন, প্রথম দিকে চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা নষ্ট করেছি। কোনো কাজ হয়নি। মেয়ের চিকিৎসা করাতে করাতেই নিঃস্ব হয়েছি। আর সুযোগ পেলে ছুটে গিয়ে সোহাগী অন্যের ক্ষতি করে। তাই বাধ্য হয়ে শিকলে বেঁধে রেখেছি। এভাবেই কাটছে ১০ বছর।
সোহাগীর প্রতিবেশী পলাশী ইউনিয়ন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্পাদক ইকবাল হোসেন বিপ্লব বলেন, মেয়েটার চিকিৎসা করাতেই পরিবারটি এখন নিঃস্ব। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেয়ে তারা মেয়েকে শিকল বেঁধে রেখেছেন। সাধ্যমত গ্রামবাসী ওই পরিবারকে সহায়তা করি। উপযুক্ত চিকিৎসা করালে হয়তো তিনি সুস্থ্য হবেন। তার সুচিকিৎসার জন্য সরকারের ঊর্দ্ধতন মহলের সহায়তা কামনা করি।