চেতনাবার্তা অনলাইন ডেস্কঃ পাপুয়া’র এক ম্যানগ্রোভ অরণ্যে শুধু মেয়েরাই প্রবেশ করতে পারে।
নাম টোনোটিওয়াট। যার অর্থ ‘ফিমেল ফরেস্ট’ বা নারীদের অরণ্য। অবশ্য টোনোটিওয়াটের অর্থ ‘ম্যানগ্রোভে স্বাগত’ও হতে পারে।
পাপুয়ার বাসিন্দাদের পছন্দের খাবার ঝিনুক এবং নানারকম ফলের জোগান দেয় এই অরণ্য। সে সব সংগ্রহ করে আনার কাজও মেয়েরাই করে থাকেন।
রাজধানী জয়পুরার ক্যামপাং এনগ্রোসের মাঝামাঝি ওই ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছড়িয়ে আছে প্রায় ৮ হেক্টর এলাকা জুড়ে।
এই অরণ্যে পুরুষেরা প্রবেশ করতে পারেন শুধুমাত্র কাঠ সংগ্রহের জন্য। তবে তার আগে তাঁদের নিশ্চিত হতে হয় যে জঙ্গলে কোনও মহিলা নেই।
মহিলা থাকাকালীন যদি কোনও পুরুষ জঙ্গলে প্রবেশ করে ধরা পড়েন, তবে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় উপজাতি আদালতে। অপরাধ প্রমাণ হলে শাস্তির পাশাপাশি দিতে হয় জরিমানাও।
জরিমানার পরিমাণ নেহাৎ কম নয়। জঙ্গলে প্রবেশ করার জন্য ১০ লক্ষ রুপাইয়া (স্থানীয় মূদ্রা) জরিমানা দিতে হয়। যা ভারতীয় মূদ্রায় পাঁচ হাজার টাকার কাছাকাছি।
মহিলাদেরও অবশ্য জঙ্গলে প্রবেশের বেশ কিছু নিয়ম আছে। এখানে মেয়েরা সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে প্রবেশ করেন। জঙ্গল, জলাভূমিতে দল বেঁধে ঘোরেন। জঙ্গলে প্রবেশের পর একত্রিত হয়ে শপথ নেন জঙ্গলে থাকাকালীন কেউ কাউকে ছেড়ে যাবেন না।
এই নিয়ম কবে থেকে চলে আসছে কেউ জানেন না। তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের মা, ঠাকুমাদের কাছেও এই একই কাহিনি শুনেছেন। প্রচলিত কাহিনী থেকেই জেনেছেন এই জঙ্গলের সঙ্গে স্থানীয়দের সখ্যতা না কি ১৮০৮ সাল থেকে।
সমুদ্র লাগোয়া জঙ্গলের জলাভূমিতে নেমে ঝিনুক সংগ্রহ করেন মেয়েরা। কাদা জলে পোশাক নষ্ট হতে পারে ভেবেই হয়তো চালু হয়েছিল পোশাক ছাড়ার নিয়ম।
থানীয় মহিলারা জানিয়েছেন, যে হেতু মেয়েদের এই জঙ্গলে নগ্ন হতে হয়, তাই হয়তো পুরুষদের দূরে রাখার নিয়ম চালু হয়েছিল।
তবে কারণ যাই হোক এই জঙ্গল পাপুয়ার মহিলাদের কাছে একটা খোলা আকাশের মতো। যেখানে তাঁরা নিজেদের মনকেও অনাবৃত করতে পারেন। ৪৫ বছরের আগস্টিনা আইও অনায়াসে দূঃখ বা আনন্দের কথা ভাগ করে নিতে পারেন ৫৮-র নেলা হাবাবুক বা ৬২-র মারিয়া মেরাউদজের সঙ্গে।
আগস্টিনা জানিয়েছেন, এখানে তাঁরা চিৎকার করে নিজেদের মনের কথা বলেন। দুঃখের কথা, এমনকি না বলতে পারা যন্ত্রণার কথাও বলেন নিশ্চিন্তে। মনকে হালকা করতে পারেন। একে অপরের কাছে পরামর্শ চাইতে বা দিতে পারেন। এক কথায় জঙ্গল তাঁদের ভাল থাকার ঠিকানা।
ইন্দোনেশিয়ার ৩৪টি প্রদেশের একটি হল পাপুয়া। এর উত্তরে প্রশান্ত মহাসাগর দক্ষিণে আরফুরা সমুদ্র। মহিলারা জানিয়েছেন, ভাটার সময় কাঠের নৌকায় চেপে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। সারা দিন থাকেন জঙ্গলেই। লম্বাটে কাঠের ওই নৌকার নাম ‘কোলে কোলে’। তার ভিতরে থাকে তাঁদের দুপুরের খাবার। জঙ্গলে ঝিনুক সংগ্রহ করতে গোটা দিন কেটে যায়। তাই দুপুরের খাবার সঙ্গে রাখা।
সারা দিনের সংগ্রহও ওই নৌকায় নিয়েই ফেরেন মহিলারা। বিক্রি করেন স্থানীয় বাজারে।
জঙ্গলে থাকার আরও একটি নিয়ম আছে। যত ক্ষণ জঙ্গলে থাকেন তত ক্ষণ গলা ছেড়ে গান করেন মহিলারা। এই গান আসলে জঙ্গলে ভুল করে ঢুকে পড়া পুরুষের প্রতি সঙ্কেত। গান গেয়েই বলা ‘তফাৎ যাও, আমরা আছি।’
তবে অগাস্টিনাদের প্রিয় জঙ্গল এখন বিপন্ন। শহরের আবর্জনা ক্রমে এসে জড়ো হচ্ছে ম্যানগ্রোভের চার পাশে। প্লাস্টিকের বোতল, পাত্র ভরে গিয়েছে সর্বত্র। স্থানীয় মহিলারা জানিয়েছেন, এখন ঝিনুক, ফলমূলের বদলে তাঁরা প্লাস্টিক খুঁজে পান বেশি।
দূষণের কারণে কমেছে ম্যানগ্রোভের জলাভূমির সম্পদও। আগে এক বেলাতেই তাঁদের কাঠের নৌকাটি সংগ্রহে ভরে যেত। এখন সারা দিন কাজ করেও অর্ধেক নৌকা ভরে না।
তবে অগাস্টিনারা জানিয়েছেন, এর পরেও জঙ্গলে আসার ঐতিহ্য ভুলবেন না তাঁরা। পরের প্রজন্মকেও উৎসাহিত করবেন। কারণ জঙ্গল তাঁদের একান্ত মুক্তির জায়গা। প্রয়োজনে এই জঙ্গল বাঁচাতে যা করতে হয় তা-ই করবেন আগামী দিনে।
স্থানীয় প্রশাসনের কথায়, শুধু মহিলাদের জন্য এমন জঙ্গল গোটা ইন্দোনেশিয়ায় আর আছে কি না তাঁদের জানা নেই। তবে এই জঙ্গলের জন্য তাঁরা গর্ববোধ করেন। কারণ, পুরুষের মনের কথা বলার অনেক জায়গা থাকে। তাঁরা মনে করেন, মহিলাদেরও তেমন সুযোগ থাকা উচিত।