প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে একগুচ্ছ সুখবর দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভাগভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আর চলতি বছরের জুন থেকে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল-ফিডিং প্রকল্প চালু হচ্ছে। বহুল প্রতিক্ষিত সহকারী শিক্ষকদের আন্তঃজেলা, আন্তঃবিভাগ ও আন্তঃসিটি করপোরেশনের মধ্যে বদলির কাজ চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হচ্ছে। আর শিক্ষকদের দেড় বছরের ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্স উঠে দিয়ে নতুন করে চালু করা হচ্ছে প্রাইমারি টিচার বেসিক ট্রেনিং (পিটিবিটি) নামের ১০ মাসের কোর্স। অপরদিকে ১৩ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে ফেব্রুয়ারির শেষে। আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্র্রুতিকটু নাম ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব সুখবর দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। আর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত, মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবুবকর সিদ্দিক ও মো. মোশাররফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
জুনে শুরু হচ্ছে স্কুল ফিডিং :
চলতি বছরের জুন থেকে স্কুল-ফিডিং প্রকল্প চালু হবে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘দারিদ্র পীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে চালু হয়ে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জুনে শেষ হয়। প্রকল্পটি দেশের ১০৪টি উপজেলায় চালু ছিলো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ, বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তি, নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি, ঝরে পড়া রোধ, যথাসময়ে শিক্ষাচক্র শেষ করাতে প্রকল্পটি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তাই দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে।
বিভাগভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ :
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শূন্যপদ পূরণে বিভাগভিত্তিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ। তিনি বলেছেন, সারা দেশে শিক্ষক নিয়োগে প্রায় দুই বছর চলে। কিন্তু প্রতি বছর অনেক শিক্ষক অবসরে চলে যান। ফলে কিছু জায়গায় শূন্যতা থাকে দীর্ঘ সময়। এজন্য আমরা বিভাগ ভিত্তিক, ক্লাস্টার ভিত্তিক নিয়োগ দেবো, এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেখা গেল কিছু দিন পর পর হয়তো ঢাকা বিভাগ বা বরিশাল বিভাগে নিয়োগ দিতে পারবো। সর্বশেষ নিয়োগে প্রায় আাড়াই হাজার শিক্ষক যোগদান করেননি বলেও জানান তিনি।
শিক্ষকদের জেলা-বিভাগে বদলির কাজ শুরু এ মাসেই :
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের আন্তঃজেলা, আন্তঃবিভাগ ও আন্তঃসিটি করপোরেশনের মধ্যে বদলির কাজ চলতি মাসে শুরু হচ্ছে বলে জানান সচিব ফরিদ আহাম্মদ। তিনি বলেন, এজন্য সফটওয়্যারের কিছু কাজ করতে হবে। আমরা তা শুরু করে দিচ্ছি।
প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, আমরা ইতোমধ্যে উপজেলার মধ্যে বদলি শুরু করেছি। ২৫ হাজার শিক্ষকের বদলি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের কার্যক্রমের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে।
ডিপিএডের বদলে চালু হচ্ছে ১০ মাসের পিটিবিটি কোর্স :
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দেড় বছরের ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্স থাকছে না। নতুন করে প্রাইমারি টিচার বেসিক ট্রেনিং (পিটিবিটি) নামের ১০ মাসের কোর্স চালু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সচিব ফরিদ আহাম্মদ। তিনি বলেন, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষক সিইনএড ছিল। পরবর্তীতে যুগের চাহিদা ও নতুন পাঠক্রম বিবেচনায় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে দেশের সাতটি পিটিআইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ডিপিএড কোর্স চালু হয়েছিলো। এখন পর্যন্ত এটি পাইলটিং হচ্ছে।
তিন বলেন, পাইলটিং চলার পর কী সুবিধা হয়েছে কী অসুবিধা হয়েছে, যুগের চাহিদা মিটআপ করতে পারছি কিনা, এর জন্য জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় পিডিপি-৪ এর আলোকে এক বছর যাবত মাঠ পর্যায়ে মতামত নিয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মশালা করে মাঠ পর্যায়ের মতামত নেয়া হয়েছে। স্টেক হোল্ডারদের মতামত নেয়া হয়েছে। এসব মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত ফলাফল এসেছে- ডিপিএডটি পরিচালিত হচ্ছে এডুকেশনাল মুডে। কিন্তু চাকরিতে ঢোকার পর ইনসার্ভিস ট্রেনিং এডুকেশন মুডে পরিচালিত হয় না। এটা হয় মৌলিক প্রশিক্ষণ।
সচিব জানান, শিক্ষকরা শিশুদের পড়াবেন। তাই, এডুকেশন মুড থেকে বের করে একেবারে চাহিদাভিত্তিক মৌলিক প্রশিক্ষণে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের এখন যে কোর্স কারিকুলাম চালু রয়েছে দেড় বছরের। যার মধ্যে ছয়মাস শিক্ষকদের স্কুলে এটাচমেন্ট ছিল। দেড় বছরের মধ্যে থিওরিটিক্যাল যা রয়েছে তা সম্পন্ন করতে চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগবে। এটাচমেন্টে ছয়মাস যে শিক্ষকরা থাকেন সেখানে কোনও রকম মনিটরিং নেই, ইভ্যালুয়েশন নেই। এটা কোনও মূল্যায়নের আওতায় আসে না। ১০ মাসের কোর্স কারিকুলাম নতুনভাবে সাজিয়েছি। এটি যুগের চাহিদা মেটাবে, বাচ্চাদের মেন্টরিং করার জন্য যথাযথভাবে বিবেচিত হবে। আগের যে কোর্স কারিকুলাম রয়েছে তার চেয়ে বেশি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণটি আগে বাধ্যতামূলক আবাসিক ছিলো না। এটি বাধ্যতামূলক আবাসিক প্রশিক্ষণ হবে। শিক্ষক যোগদান করার পর যদি সাত বছর আট বছর পর মৌলিক প্রশিক্ষণ পান তাহলে প্রশিক্ষণ কোনো কাজে লাগে না। সে কারণে আমরা ১০ মাসের পিটিবিটি কোর্স চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বৃত্তি পরীক্ষার ফল এ মাসের শেষে :
প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল আগামী ২৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারিা মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন সচিব ফরিদ আহাম্মদ। গত ৩০ ডিসেম্বর পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তাদের এ পরীক্ষার ফল চলতি মাসের শেষে প্রকাশ হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানা গেছে, তারা বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহিত ফল একটি সফটওয়্যারে অন্তুর্ভুক্ত করছেন। এবার প্রাথমিক বৃত্তি পাবেন সাড়ে ৮২ হাজার শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী ট্যালেন্টপুলে ও সাড়ে ৪৯ হাজার শিক্ষার্থী সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাবেন।
স্কুলের শ্রুতিকটু নাম পরিবর্তন
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রুতিকটু ও নেতিবাচক নাম পরিবর্তনে একটি নীতিমালা করা হয়েছে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেছেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তিত নাম গেজেট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় এসব বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে সুন্দর, রুচিশীল, শ্রুতিমধুর এবং স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় ইতিহাস, সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নামকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সচিব ফরিদ আহাম্মদ অনেক বিদ্যালয়ের নাম শ্রুতিকটু, যা শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমি বরিশালে গিয়েছিলাম, সেখানে একটি স্কুলের নাম চরকাউয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের এলাকার একটি স্কুলের নাম মহিষ খোঁচা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গফরগাঁওয়ে একটি স্কুলের নাম চোরের ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একজন শিশু যখন স্কুলে যায় এ নিয়ে তার মধ্যে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, আমরা এটার ওপর কাজ করে একটা নীতিমালা গত ১৯ জানুয়ারি জারি করেছি। এ বিষয়ে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে দুটি কমিটি করে দিয়েছি। কমিটির মাধ্যমে প্রস্তাবগুলো আসছে। অধিদপ্তরের মাধ্যমে আগামী ছয় মাসের মধ্যে নামগুলো পরিবর্তন করবো। একই সঙ্গে শ্রুতিমধুর, স্থানীয় ইতিহাস-সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই, মুক্তিযোদ্ধা বা বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে স্কুলগুলোর নাম পরিবর্তন করা হবে। ২০০টির মতো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এমন শ্রুতিকটু নাম রয়েছে। নাম পাওয়ার পর আমরা তা পরিবর্তন করে গেজেট করবো।